বন্ধুত্ব থেকে প্রেম
বন্ধুত্ব থেকে প্রেম
মাহি , অত্যন্ত হাসিখুশি , প্রাঞ্জল এক ছেলে । বন্ধুমহলে তার জনপ্রিয়তা খারাপ না । একটু পাগলামি আর ঠোঁটকাটা স্বভাব সাথে থাকায় বন্ধুদের মাঝে কয়েকজন কেন জানি তাকে একটু বেশিই পছন্দ করে । সেই কয়েকজনের মধ্যে অর্ণব একজন । অর্ণব আর মাহি সেই তৃতীয় শ্রেণী থেকে এক সাথে ।শৈশব থেকে কৈশোর , তার পর তারুণ্য । একসাথে দীর্ঘদিনের পথ চলা । তাদের বন্ধুমহলটা অনেক বড় , প্রায় বিশ পঁচিশ জনের দল । প্রতিদিন বিকালে স্কুলের মাঠে খেলাধুলা আর সন্ধ্যায় আড্ডাবাজই তাদের দলটাকে টুকরো টুকরো হতে দেয়নি । সবাই এখনও স্কুল জীবনের মত একসাথে আছে ।
কয়েকজন ঢাকা , কয়েকজন সিলেট পড়াশুনা করে । যে যেখানেই থাক , ছুটিতে সবাই একসাথে ।
অর্ণবের সবচেয়ে কাছের বন্ধু তিনজন । আরিফ , নীল এবং রিমি । অন্যদিকে মাহির বন্ধুমহল বিশাল । অর্ণব যখন স্কুল জীবনে কোচিং করত , তখন তার সাথে এক ক্লাসে পড়ত রাত্রি । দুজনের পরিবারের মাঝে জানাশোনা ছিল , কিন্তু নিজেদের মধ্যে তারা কখনো কথা বলেনি । অর্ণবের চোখে কখনো রাত্রিকে বিশেষ কিছু মনে হয়নি । তবে রাত্রির দুষ্টুমি ভরা চোখ , আর ছটফটানি ভরা চালচলন দেখে বেশ মজা লাগত তার । তাদের কোচিং এক হলেও স্কুল ছিল আলাদা । এ কারণে হয়ত তাদের মাঝে বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয়নি , অর্ণবেরও এ নিয়ে মাথাব্যথা ছিলনা । স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে তারা একসময় কলেজে ভর্তি হল ।বলা বাহুল্য এক কলেজে এবং এক রুমে তারা ক্লাস করত । তাদের রোল ছিল পাশাপাশি । পরীক্ষায় টুকটাক কথা ছাড়া আর সেরকম কোন কথা হতোনা। রাত্রিদের বান্ধবীরা কয়েকজন একসাথে থাকত সবসময় , রিমিও ছিল এদের একজন । রিমি সহ আরও কয়েকজনের সাথে আবার অর্ণবের ভালো সম্পর্ক ছিল । কলেজের শুরুতেই সে জানতে পারে মাহি রাত্রির প্রেমে পড়েছে । বন্ধুমহলে এই নিয়ে কত হাসাহাসি , দুষ্টামি । অর্ণব নিজেও মাহিকে নিয়ে খোঁচাখোঁচি করে । তবে সবাই চায় পাগল মাহির একটা গতি হোক । অর্ণব নিজেও চায় । মাহিও একই কলেজে পড়ে , কিন্তু মানবিক বিভাগে । সে কারণে রাত্রিকে দেখার জন্য তাকে বিজ্ঞান বিভাগের ক্লাসের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা যায় । একদিন সাহস করে মাহি রাত্রিকে জানায় তার মনের কথা , তার ভালবাসার কথা । রাত্রি এক কথায় তাকে না করে দেয় । সে জানায় এসবের জন্য তার সময় বা ইচ্ছা কোনটাই নেই । ভগ্নহৃদয় মাহি মুখ ভোতা করে বন্ধুদের কাছে ফিরে আসে , তারা লাইব্রেরির সামনে অপেক্ষা করছিল । মাহির মুখে সব শুনে প্রথমে সবাই খেপে গেলেও পরে বুঝল এসব কাজে তাড়াহুড়া করা ঠিক না । সবাই মাহিকে এই বলে সান্ত্বনা দিল যে “সময়ের সাথে রাত্রির মনে নিশ্চয়ই পরিবর্তন আসবে । তুই লেগে থাক “। এভাবে প্রথম বর্ষ চলে গেল । দিন দিন মাহির রাত্রির জন্য পাগলামি বাড়ছে , অন্যদিকে অর্ণব আর রিমির বন্ধুত্ব গভীর হচ্ছে । বন্ধুদের মনে প্রথমদিকে সংশয় থাকলেও অল্পদিনে তারা বুঝতে পারল অর্ণব আর রিমির মধ্যে নিখুঁত বন্ধুত্ব ব্যতীত অন্য কোন সম্পর্ক নেই । প্রথমদিকে তারা ব্যাপারটা নিয়ে দুষ্টামি করলেও যখন বুঝল সম্পর্কটা সুধুই বন্ধুত্বের তখন তারা এই দুজনকে জ্বালাতন করা ছেড়ে দিল । রিমি ছিল রাত্রির কাছের বান্ধবী , আর এদিকে অর্ণব মাহির একটা শুভ পরিণতি চাইত । তাই অর্ণব চেষ্টা করছিল রিমিকে দিয়ে রাত্রিকে বোঝাতে মাহির মনের অবস্থা । এতে যদি রাত্রির মন নরম হয় ।
রিমি কিছু কিছু চেষ্টা করল , তবে সরাসরি নয় । অন্যভাবে । গল্পে গল্পে , কখনো ঠাট্টার ছলে রাত্রিকে কয়েকবার বোঝাল মাহি তাকে কতটা পছন্দ করে ।
কিন্তু সকল চেষ্টা বিফলে গেল । কেন জানি রাত্রির মনটা এক কংক্রিটের আবরণে মোড়া , যা ভেদ করে দাগ ফেলা রিমির পক্ষে সম্ভব ছিলনা । কে জানে ,হয়ত সেই কংক্রিটে মোড়া মন-প্রাসাদে কোন রাজপুত্র আছে , প্রচ্ছন্ন , ছায়ার মত , গহিনে লুকানো । তাই হয়ত মাহির জন্য রাত্রির অন্তরের অন্তঃপুরে কোন জায়গা নেই । রিমির সকল প্রচেষ্টা যদিও ব্যর্থ কিন্তু এর থেকে একটা ভালো দিক দারিয়ে গেল । রাত্রি আর মাহিকে নিয়ে গবেষণা করতে করতে অর্ণব আর রিমির বন্ধুত্বটা অত্যন্ত শক্ত এক মাটির উপর দারিয়ে গেল । স্বচ্ছ , নির্মল , নিঃস্বার্থ এক বন্ধুত্ব । দ্বিতীয় বর্ষ এভাবে গেল । পরীক্ষা , পড়াশুনা ,ভর্তি কোচিং , অবশেষে ভর্তি । সব বন্ধু আলাদা আলাদা । কিন্তু ছুটিতে , পূজায় , ঈদে সব বন্ধু একত্রিত হয় । সেই আড্ডা , খেলাধুলা , পরচর্চা । ভালই চলছিল সব । সহজ সরল নির্মল আনন্দময় জীবন । কিন্তু বিধাতা হয়ত আড়াল থেকে মুচকি হাসছিলেন । কারণ তিনি তাকিয়ে ছিলেন ভবিষ্যতের দিকে ।
সবার ছুটিছাটা ছাড়া খুব একটা দেখা হয় না । ছেলেদের যা দেখা হয় , মেয়েদের তো পাওয়াই যায় না । মোবাইলের যুগ , ফেসবুক তো আছেই । এই মোবাইলের কল্যাণে অর্ণব সকলের সাথে যোগাযোগ রাখে সবসময় । এভাবেই রাত্রির সাথে কদাচিৎ কয়েকবার কথা হয় । দিন দিন যোগাযোগটা বাড়তে থাকে । প্রথমদিকে দুজনের কেউ ব্যাপারটা সেভাবে লক্ষ করেনি । কথা বলে মজা লাগত কারণ দুজন কলেজে কখনো সেভাবে কথা বলেনি । মোবাইলে কথা বলে দুজন দুজনকে নতুন করে নতুন রূপে আবিষ্কার করে । একজন মানুষের অনেক রূপ অনেক মুখোশের আড়ালে থাকে । তার সাথে দীর্ঘ সময় কাটালে তার ভিতরের রূপগুলি একে একে প্রকাশিত হতে থাকে । খুব কচি বয়স দুজনার , এ বয়সে মানুষ বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সহজে আকৃষ্ট হয় । একে অপরের ভেতরের রহস্য তারা যতই আবিষ্কার করতে থাকে , ততই নিজেদের অজান্তে তারা পরস্পরের মাঝে হারিয়ে যেতে থাকে । তারা দুজনেই একটু সন্দিহান ছিল এটাই কি প্রেম ? নিশ্চিত হওয়ার কোন রাস্তা তাদের জানা ছিলনা । রাত্রি ব্যাপারটা নিয়ে খুশি ছিল , কিন্তু দুশ্চিন্তার কাল মেঘ ধেয়ে আসছিল অর্ণবের মনের আকাশে । সে অপরাধবোধে ভুগছিল । সে জানে মাহি রাত্রিকে কতটা ভালবাসে । সে জানে মাহির ভালবাসা পবিত্র , সত্য ও গভীর ।
নিজের ভাগ্যকে গালি দেয় সে , কোন কুক্ষণে রাত্রির সাথে কথা শুরু করেছিল সে । কিন্তু সে তো এসব ভেবে কথা শুরু করেনি । সে যোগাযোগ রাখার জন্য অন্যদের মত টুকটাক কথা বলত মাঝে মাঝে । এই টুকটাক আর মাঝেমাঝে কখন যে সময়ের সাথে বদলে গেল , এখন প্রতিদিন কয়েকবার লম্বা সময় ধরে কথা না বললে দুজনের কেউ থাকতে পারেনা । অর্ণব বুঝতে পারছে সে যা করছে তা বন্ধুত্বের চরম অপমান করা , কিন্তু সে কি করবে ? এখন কথা এতদূর গড়িয়ে গেছে যে হয় মাহি নয় রাত্রি , কেউ একজনের মন ভাঙ্গবে । দিক-বিভ্রান্ত অর্ণব তাই রিমির কাছে পরামর্শ চায় । কি করবে সে । রিমি অর্ণবের সবকিছু জানে , সে বুঝতে পারে তার বন্ধুর মনের অবস্থা । রিমির পরামর্শে অর্ণব চেষ্টা করে রাত্রিকে এড়িয়ে চলতে । সক্ষম হয়না সে , পারেনা রাত্রির কান্না ভেজা চোখে বর্ষার ঢল নামাতে । শুধু তাই নয় , তার এই এড়িয়ে চলার চেষ্টার ফল হয় উল্টা । রাত্রি পুরোপুরি বুঝতে পারে অর্ণবকে সে ভালবাসে । যে ব্যাপারটা নিয়ে তার দোটানা ছিল , অনিশ্চয়তা ছিল , তা দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যায় । বিরহ নাকি প্রেমের গভীরতা বুঝতে সাহায্য করে , রাত্রির জীবনে কথাটি সত্যি হয়ে ধরা দেয় । অর্ণবের অল্প কয়েকদিনের এড়িয়ে চলা , তার কয়েকদিনের অনুপস্থিতি , রাত্রিকে বুঝিয়ে দেয় তার জীবনে অর্ণব কত বিশাল যায়গা জুড়ে আছে । অর্ণব আর রাত্রির ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে , সেই সাথে বাড়তে থাকে অর্ণবের অপরাধবোধ । ঘনিষ্ঠতা বাড়লেও তখনও একে অপরকে সরাসরি ভালবাসার কথা বলেনি কেউ। কয়েকদিন ধরে রাত্রির কথায় , দুষ্টামিতে , হাসি , গল্পে ভালবাসার প্রকাশ হচ্ছিল ।
পরস্পরের উপর তারা তখন অনেক বেশি নির্ভর করতে শুরু করে । এই ভয়টাই অর্ণবকে তারিয়ে বেড়াচ্ছিল । সে বুঝতে পারছিলনা কি করবে । একদিন অর্ণব রাত্রির সাথে পুরো বিষয়টা নিয়ে সরাসরি আলোচনায় গেল । ফল হল বিপরীত । রাত্রি অর্ণবের যুক্তি মানতে রাজি হচ্ছিল না । একপর্যায়ে অর্ণব রাত্রিকে বলে যে “দেখ মাহি তোমাকে অন্তর থেকে ভালবাসে , তার বন্ধু হয়ে, সবকিছু জেনে শুনে আমি তোমার সাথে কোনরকম সম্পর্কে যেতে পারিনা , তা হয়না ’’ । শুনে উল্টো ক্ষেপে যায় রাত্রি । “ মাহি যদি আমায় পছন্দ করে তবে আমার কি করার আছে ? এটা কি আমার দোষ ? তুমি আমাকে চাও কিনা সেটা আমার দেখার বিষয় , অন্যরা কি করে , কি চায় তা আমার জানার দরকার নেই । তুমি বল , তুমি কি আমায় ভালোবাসো ’’? নীরব থাকে অর্ণব ।নিয়তির খেলায় বাক্যহারা হয়ে যায় সে । রাত্রির প্রশ্নের কোন জবাব সে দিতে পারেনা । কি বলবে সে ? যাই বলবে , তাতে একজনের হৃদয়ে শেল বিদ্ধ হবে। রক্তপাত হবে হয় মাহির নয় রাত্রির হৃদয়ে । চুপচাপ থাকে দুজনেই , বেশ কয়েক মিনিট । এর ভিতরে রাত্রির রাগ কিছুটা হলেও নেমে এসেছে । হয়ত অর্ণবের মানসিক অবস্থা কিছুটা উপলব্ধিও করতে পারে । সেই প্রথমে অর্ণবকে বলে তুমি এখনও আমায় বলতে পারলে না তোমার ভালবাসার কথা ।
স্বীকার কর আর নাই কর , সত্যি আমি জানি । বলতে না চাও , থাক । জোর করবোনা । দূরে সরে যেতে চাও , যাও । যদি ভাব এতে তোমার বন্ধুর খুব একটা লাভ হবে , তবে তুমি ভুল করছ । আমি যেমন আছি তেমনি থাকব , তোমার বন্ধুর সাথে আমার সম্পর্কের কথা স্বপ্নেও চিন্তা করোনা । তুমি সময় চাও ? ঠিক আছে , সময় নাও । আমি আর তোমাকে খুব বেশি বিরক্ত করবোনা । তুমি না চাইলে তোমাকে ফোন করব না । তুমি তোমার পড়াশুনা নিয়ে থাক , আমি আমার পড়াশুনা নিয়ে । আমি অপেক্ষা করব । জানি তুমি ফিরে আসবে । অর্ণব চুপ করে কথাগুলি শুনে , রাত্রি ওপাশে ফোন রেখে দেয় ।
তবুও কানে ফোন লাগিয়ে কি এক ভাবনায় ডুবে যায় অর্ণব । একসময় ধ্যান ভঙ্গ হয় তার । নিজে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস করতে না পেরে রিমিকে ফোন করে সব বলে সে । কি করবে বুঝতে না পেরে রিমির সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করতে চায় । কিন্তু রিমি বেচারি কি বলবে ? অর্ণব , রাত্রি , মাহি সবাই তার বন্ধু । তাই রিমি অনেক ভেবে অর্ণবকে বলে কয়েকদিনের জন্য এই বিষয়টা থেকে দূরে থাক । যদি সম্ভব হয় , তাহলে তো ভালই । না হলে ভাগ্যে যা আছে তাই হবে । এত টেনশন করার কিছু নেই । রিমি অর্ণবকে এসব চিন্তা কমিয়ে পড়াশুনায় মনযোগী হতে বলে । অর্ণব রিমির কথা মেনে যোগাযোগ কিছুদিনের জন্য কমাবার সিদ্ধান্ত নেয় ।
চার-পাচ দিন কেটে যায় । অর্ণব রাত্রি উভয়ের এক অদ্ভুত সময় কাটে , ফাঁকাফাঁকা নিঃসঙ্গ । সবার সাথে থেকেও নিজেদের নিঃসঙ্গ বোধ করে তারা ।
জীবনে কোন এক রঙের অভাব তাদের থেকেই যায় । চারিপাশে ভালোলাগার মত কিছু খুঁজে পায়না তারা । পালাবার পথ খুঁজে বেড়ায় চোখ , কিন্তু পালাবে কোথায় ? গন্তব্য যে জানা নেই কারও। কয়েকটা দিন এভাবেই ধুকতে ধুকতে চলে যায় । আবেগের নিয়ন্ত্রণে বরাবর মানব চিত্ত দুর্বল । এ যে এক ধ্রুব সত্য তা অর্ণব আর রাত্রির জীবনে প্রমাণিত হয় । ফলশ্রুতিতে দুজনের মধ্যে আবার কথা বলা শুরু হয় । দিন দিন তা বাড়তে থাকে । দুজন আবার কাছাকাছি আসতে থাকে । তারপরেও কোথাও যেন একটু ফাঁক থেকেই যায় । ছোটও একটা কাঁটা যেন কোথায় আটকে থাকে । এই কাঁটাটার কারণে পরস্পরকে ‘ভালবাসি’ শব্দটা বলা হয়না । বলা হবে কি ? বলা কি উচিত ? বললে এটা কি অর্ণবের মাহির সাথে প্রতারণা করা হবে না ? অর্ণব জানেনা এর উত্তর কি । ইসস জীবনটা যদি গল্পের মত হত । সর্বদা ‘Happy Ending’ । কিন্তু বাস্তবতা গল্পের মত সোজা রাস্তায় চলেনা , এর মোড়ে মোড়ে দুর্গন্ধময় ময়লা জমে থাকে , যা আমাদেরকে কখনো এতোটাই অসহায় বানায় যে হাতের মুঠোয় প্রাচুর্য থাকার পরেও আমরা নিঃস্ব রিক্তই থেকে যাই । হয়ত একেই নিয়তি বলে , যে নিয়তির হাতে অসহায় আমাদের অর্ণব এক বুক বেদনা নিয়ে সমাধানের আশায় প্রহর গুনে ।
মাহি , অত্যন্ত হাসিখুশি , প্রাঞ্জল এক ছেলে । বন্ধুমহলে তার জনপ্রিয়তা খারাপ না । একটু পাগলামি আর ঠোঁটকাটা স্বভাব সাথে থাকায় বন্ধুদের মাঝে কয়েকজন কেন জানি তাকে একটু বেশিই পছন্দ করে । সেই কয়েকজনের মধ্যে অর্ণব একজন । অর্ণব আর মাহি সেই তৃতীয় শ্রেণী থেকে এক সাথে ।শৈশব থেকে কৈশোর , তার পর তারুণ্য । একসাথে দীর্ঘদিনের পথ চলা । তাদের বন্ধুমহলটা অনেক বড় , প্রায় বিশ পঁচিশ জনের দল । প্রতিদিন বিকালে স্কুলের মাঠে খেলাধুলা আর সন্ধ্যায় আড্ডাবাজই তাদের দলটাকে টুকরো টুকরো হতে দেয়নি । সবাই এখনও স্কুল জীবনের মত একসাথে আছে ।
কয়েকজন ঢাকা , কয়েকজন সিলেট পড়াশুনা করে । যে যেখানেই থাক , ছুটিতে সবাই একসাথে ।
অর্ণবের সবচেয়ে কাছের বন্ধু তিনজন । আরিফ , নীল এবং রিমি । অন্যদিকে মাহির বন্ধুমহল বিশাল । অর্ণব যখন স্কুল জীবনে কোচিং করত , তখন তার সাথে এক ক্লাসে পড়ত রাত্রি । দুজনের পরিবারের মাঝে জানাশোনা ছিল , কিন্তু নিজেদের মধ্যে তারা কখনো কথা বলেনি । অর্ণবের চোখে কখনো রাত্রিকে বিশেষ কিছু মনে হয়নি । তবে রাত্রির দুষ্টুমি ভরা চোখ , আর ছটফটানি ভরা চালচলন দেখে বেশ মজা লাগত তার । তাদের কোচিং এক হলেও স্কুল ছিল আলাদা । এ কারণে হয়ত তাদের মাঝে বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয়নি , অর্ণবেরও এ নিয়ে মাথাব্যথা ছিলনা । স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে তারা একসময় কলেজে ভর্তি হল ।বলা বাহুল্য এক কলেজে এবং এক রুমে তারা ক্লাস করত । তাদের রোল ছিল পাশাপাশি । পরীক্ষায় টুকটাক কথা ছাড়া আর সেরকম কোন কথা হতোনা। রাত্রিদের বান্ধবীরা কয়েকজন একসাথে থাকত সবসময় , রিমিও ছিল এদের একজন । রিমি সহ আরও কয়েকজনের সাথে আবার অর্ণবের ভালো সম্পর্ক ছিল । কলেজের শুরুতেই সে জানতে পারে মাহি রাত্রির প্রেমে পড়েছে । বন্ধুমহলে এই নিয়ে কত হাসাহাসি , দুষ্টামি । অর্ণব নিজেও মাহিকে নিয়ে খোঁচাখোঁচি করে । তবে সবাই চায় পাগল মাহির একটা গতি হোক । অর্ণব নিজেও চায় । মাহিও একই কলেজে পড়ে , কিন্তু মানবিক বিভাগে । সে কারণে রাত্রিকে দেখার জন্য তাকে বিজ্ঞান বিভাগের ক্লাসের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা যায় । একদিন সাহস করে মাহি রাত্রিকে জানায় তার মনের কথা , তার ভালবাসার কথা । রাত্রি এক কথায় তাকে না করে দেয় । সে জানায় এসবের জন্য তার সময় বা ইচ্ছা কোনটাই নেই । ভগ্নহৃদয় মাহি মুখ ভোতা করে বন্ধুদের কাছে ফিরে আসে , তারা লাইব্রেরির সামনে অপেক্ষা করছিল । মাহির মুখে সব শুনে প্রথমে সবাই খেপে গেলেও পরে বুঝল এসব কাজে তাড়াহুড়া করা ঠিক না । সবাই মাহিকে এই বলে সান্ত্বনা দিল যে “সময়ের সাথে রাত্রির মনে নিশ্চয়ই পরিবর্তন আসবে । তুই লেগে থাক “। এভাবে প্রথম বর্ষ চলে গেল । দিন দিন মাহির রাত্রির জন্য পাগলামি বাড়ছে , অন্যদিকে অর্ণব আর রিমির বন্ধুত্ব গভীর হচ্ছে । বন্ধুদের মনে প্রথমদিকে সংশয় থাকলেও অল্পদিনে তারা বুঝতে পারল অর্ণব আর রিমির মধ্যে নিখুঁত বন্ধুত্ব ব্যতীত অন্য কোন সম্পর্ক নেই । প্রথমদিকে তারা ব্যাপারটা নিয়ে দুষ্টামি করলেও যখন বুঝল সম্পর্কটা সুধুই বন্ধুত্বের তখন তারা এই দুজনকে জ্বালাতন করা ছেড়ে দিল । রিমি ছিল রাত্রির কাছের বান্ধবী , আর এদিকে অর্ণব মাহির একটা শুভ পরিণতি চাইত । তাই অর্ণব চেষ্টা করছিল রিমিকে দিয়ে রাত্রিকে বোঝাতে মাহির মনের অবস্থা । এতে যদি রাত্রির মন নরম হয় ।
রিমি কিছু কিছু চেষ্টা করল , তবে সরাসরি নয় । অন্যভাবে । গল্পে গল্পে , কখনো ঠাট্টার ছলে রাত্রিকে কয়েকবার বোঝাল মাহি তাকে কতটা পছন্দ করে ।
কিন্তু সকল চেষ্টা বিফলে গেল । কেন জানি রাত্রির মনটা এক কংক্রিটের আবরণে মোড়া , যা ভেদ করে দাগ ফেলা রিমির পক্ষে সম্ভব ছিলনা । কে জানে ,হয়ত সেই কংক্রিটে মোড়া মন-প্রাসাদে কোন রাজপুত্র আছে , প্রচ্ছন্ন , ছায়ার মত , গহিনে লুকানো । তাই হয়ত মাহির জন্য রাত্রির অন্তরের অন্তঃপুরে কোন জায়গা নেই । রিমির সকল প্রচেষ্টা যদিও ব্যর্থ কিন্তু এর থেকে একটা ভালো দিক দারিয়ে গেল । রাত্রি আর মাহিকে নিয়ে গবেষণা করতে করতে অর্ণব আর রিমির বন্ধুত্বটা অত্যন্ত শক্ত এক মাটির উপর দারিয়ে গেল । স্বচ্ছ , নির্মল , নিঃস্বার্থ এক বন্ধুত্ব । দ্বিতীয় বর্ষ এভাবে গেল । পরীক্ষা , পড়াশুনা ,ভর্তি কোচিং , অবশেষে ভর্তি । সব বন্ধু আলাদা আলাদা । কিন্তু ছুটিতে , পূজায় , ঈদে সব বন্ধু একত্রিত হয় । সেই আড্ডা , খেলাধুলা , পরচর্চা । ভালই চলছিল সব । সহজ সরল নির্মল আনন্দময় জীবন । কিন্তু বিধাতা হয়ত আড়াল থেকে মুচকি হাসছিলেন । কারণ তিনি তাকিয়ে ছিলেন ভবিষ্যতের দিকে ।
সবার ছুটিছাটা ছাড়া খুব একটা দেখা হয় না । ছেলেদের যা দেখা হয় , মেয়েদের তো পাওয়াই যায় না । মোবাইলের যুগ , ফেসবুক তো আছেই । এই মোবাইলের কল্যাণে অর্ণব সকলের সাথে যোগাযোগ রাখে সবসময় । এভাবেই রাত্রির সাথে কদাচিৎ কয়েকবার কথা হয় । দিন দিন যোগাযোগটা বাড়তে থাকে । প্রথমদিকে দুজনের কেউ ব্যাপারটা সেভাবে লক্ষ করেনি । কথা বলে মজা লাগত কারণ দুজন কলেজে কখনো সেভাবে কথা বলেনি । মোবাইলে কথা বলে দুজন দুজনকে নতুন করে নতুন রূপে আবিষ্কার করে । একজন মানুষের অনেক রূপ অনেক মুখোশের আড়ালে থাকে । তার সাথে দীর্ঘ সময় কাটালে তার ভিতরের রূপগুলি একে একে প্রকাশিত হতে থাকে । খুব কচি বয়স দুজনার , এ বয়সে মানুষ বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সহজে আকৃষ্ট হয় । একে অপরের ভেতরের রহস্য তারা যতই আবিষ্কার করতে থাকে , ততই নিজেদের অজান্তে তারা পরস্পরের মাঝে হারিয়ে যেতে থাকে । তারা দুজনেই একটু সন্দিহান ছিল এটাই কি প্রেম ? নিশ্চিত হওয়ার কোন রাস্তা তাদের জানা ছিলনা । রাত্রি ব্যাপারটা নিয়ে খুশি ছিল , কিন্তু দুশ্চিন্তার কাল মেঘ ধেয়ে আসছিল অর্ণবের মনের আকাশে । সে অপরাধবোধে ভুগছিল । সে জানে মাহি রাত্রিকে কতটা ভালবাসে । সে জানে মাহির ভালবাসা পবিত্র , সত্য ও গভীর ।
নিজের ভাগ্যকে গালি দেয় সে , কোন কুক্ষণে রাত্রির সাথে কথা শুরু করেছিল সে । কিন্তু সে তো এসব ভেবে কথা শুরু করেনি । সে যোগাযোগ রাখার জন্য অন্যদের মত টুকটাক কথা বলত মাঝে মাঝে । এই টুকটাক আর মাঝেমাঝে কখন যে সময়ের সাথে বদলে গেল , এখন প্রতিদিন কয়েকবার লম্বা সময় ধরে কথা না বললে দুজনের কেউ থাকতে পারেনা । অর্ণব বুঝতে পারছে সে যা করছে তা বন্ধুত্বের চরম অপমান করা , কিন্তু সে কি করবে ? এখন কথা এতদূর গড়িয়ে গেছে যে হয় মাহি নয় রাত্রি , কেউ একজনের মন ভাঙ্গবে । দিক-বিভ্রান্ত অর্ণব তাই রিমির কাছে পরামর্শ চায় । কি করবে সে । রিমি অর্ণবের সবকিছু জানে , সে বুঝতে পারে তার বন্ধুর মনের অবস্থা । রিমির পরামর্শে অর্ণব চেষ্টা করে রাত্রিকে এড়িয়ে চলতে । সক্ষম হয়না সে , পারেনা রাত্রির কান্না ভেজা চোখে বর্ষার ঢল নামাতে । শুধু তাই নয় , তার এই এড়িয়ে চলার চেষ্টার ফল হয় উল্টা । রাত্রি পুরোপুরি বুঝতে পারে অর্ণবকে সে ভালবাসে । যে ব্যাপারটা নিয়ে তার দোটানা ছিল , অনিশ্চয়তা ছিল , তা দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যায় । বিরহ নাকি প্রেমের গভীরতা বুঝতে সাহায্য করে , রাত্রির জীবনে কথাটি সত্যি হয়ে ধরা দেয় । অর্ণবের অল্প কয়েকদিনের এড়িয়ে চলা , তার কয়েকদিনের অনুপস্থিতি , রাত্রিকে বুঝিয়ে দেয় তার জীবনে অর্ণব কত বিশাল যায়গা জুড়ে আছে । অর্ণব আর রাত্রির ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে , সেই সাথে বাড়তে থাকে অর্ণবের অপরাধবোধ । ঘনিষ্ঠতা বাড়লেও তখনও একে অপরকে সরাসরি ভালবাসার কথা বলেনি কেউ। কয়েকদিন ধরে রাত্রির কথায় , দুষ্টামিতে , হাসি , গল্পে ভালবাসার প্রকাশ হচ্ছিল ।
পরস্পরের উপর তারা তখন অনেক বেশি নির্ভর করতে শুরু করে । এই ভয়টাই অর্ণবকে তারিয়ে বেড়াচ্ছিল । সে বুঝতে পারছিলনা কি করবে । একদিন অর্ণব রাত্রির সাথে পুরো বিষয়টা নিয়ে সরাসরি আলোচনায় গেল । ফল হল বিপরীত । রাত্রি অর্ণবের যুক্তি মানতে রাজি হচ্ছিল না । একপর্যায়ে অর্ণব রাত্রিকে বলে যে “দেখ মাহি তোমাকে অন্তর থেকে ভালবাসে , তার বন্ধু হয়ে, সবকিছু জেনে শুনে আমি তোমার সাথে কোনরকম সম্পর্কে যেতে পারিনা , তা হয়না ’’ । শুনে উল্টো ক্ষেপে যায় রাত্রি । “ মাহি যদি আমায় পছন্দ করে তবে আমার কি করার আছে ? এটা কি আমার দোষ ? তুমি আমাকে চাও কিনা সেটা আমার দেখার বিষয় , অন্যরা কি করে , কি চায় তা আমার জানার দরকার নেই । তুমি বল , তুমি কি আমায় ভালোবাসো ’’? নীরব থাকে অর্ণব ।নিয়তির খেলায় বাক্যহারা হয়ে যায় সে । রাত্রির প্রশ্নের কোন জবাব সে দিতে পারেনা । কি বলবে সে ? যাই বলবে , তাতে একজনের হৃদয়ে শেল বিদ্ধ হবে। রক্তপাত হবে হয় মাহির নয় রাত্রির হৃদয়ে । চুপচাপ থাকে দুজনেই , বেশ কয়েক মিনিট । এর ভিতরে রাত্রির রাগ কিছুটা হলেও নেমে এসেছে । হয়ত অর্ণবের মানসিক অবস্থা কিছুটা উপলব্ধিও করতে পারে । সেই প্রথমে অর্ণবকে বলে তুমি এখনও আমায় বলতে পারলে না তোমার ভালবাসার কথা ।
স্বীকার কর আর নাই কর , সত্যি আমি জানি । বলতে না চাও , থাক । জোর করবোনা । দূরে সরে যেতে চাও , যাও । যদি ভাব এতে তোমার বন্ধুর খুব একটা লাভ হবে , তবে তুমি ভুল করছ । আমি যেমন আছি তেমনি থাকব , তোমার বন্ধুর সাথে আমার সম্পর্কের কথা স্বপ্নেও চিন্তা করোনা । তুমি সময় চাও ? ঠিক আছে , সময় নাও । আমি আর তোমাকে খুব বেশি বিরক্ত করবোনা । তুমি না চাইলে তোমাকে ফোন করব না । তুমি তোমার পড়াশুনা নিয়ে থাক , আমি আমার পড়াশুনা নিয়ে । আমি অপেক্ষা করব । জানি তুমি ফিরে আসবে । অর্ণব চুপ করে কথাগুলি শুনে , রাত্রি ওপাশে ফোন রেখে দেয় ।
তবুও কানে ফোন লাগিয়ে কি এক ভাবনায় ডুবে যায় অর্ণব । একসময় ধ্যান ভঙ্গ হয় তার । নিজে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস করতে না পেরে রিমিকে ফোন করে সব বলে সে । কি করবে বুঝতে না পেরে রিমির সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করতে চায় । কিন্তু রিমি বেচারি কি বলবে ? অর্ণব , রাত্রি , মাহি সবাই তার বন্ধু । তাই রিমি অনেক ভেবে অর্ণবকে বলে কয়েকদিনের জন্য এই বিষয়টা থেকে দূরে থাক । যদি সম্ভব হয় , তাহলে তো ভালই । না হলে ভাগ্যে যা আছে তাই হবে । এত টেনশন করার কিছু নেই । রিমি অর্ণবকে এসব চিন্তা কমিয়ে পড়াশুনায় মনযোগী হতে বলে । অর্ণব রিমির কথা মেনে যোগাযোগ কিছুদিনের জন্য কমাবার সিদ্ধান্ত নেয় ।
চার-পাচ দিন কেটে যায় । অর্ণব রাত্রি উভয়ের এক অদ্ভুত সময় কাটে , ফাঁকাফাঁকা নিঃসঙ্গ । সবার সাথে থেকেও নিজেদের নিঃসঙ্গ বোধ করে তারা ।
জীবনে কোন এক রঙের অভাব তাদের থেকেই যায় । চারিপাশে ভালোলাগার মত কিছু খুঁজে পায়না তারা । পালাবার পথ খুঁজে বেড়ায় চোখ , কিন্তু পালাবে কোথায় ? গন্তব্য যে জানা নেই কারও। কয়েকটা দিন এভাবেই ধুকতে ধুকতে চলে যায় । আবেগের নিয়ন্ত্রণে বরাবর মানব চিত্ত দুর্বল । এ যে এক ধ্রুব সত্য তা অর্ণব আর রাত্রির জীবনে প্রমাণিত হয় । ফলশ্রুতিতে দুজনের মধ্যে আবার কথা বলা শুরু হয় । দিন দিন তা বাড়তে থাকে । দুজন আবার কাছাকাছি আসতে থাকে । তারপরেও কোথাও যেন একটু ফাঁক থেকেই যায় । ছোটও একটা কাঁটা যেন কোথায় আটকে থাকে । এই কাঁটাটার কারণে পরস্পরকে ‘ভালবাসি’ শব্দটা বলা হয়না । বলা হবে কি ? বলা কি উচিত ? বললে এটা কি অর্ণবের মাহির সাথে প্রতারণা করা হবে না ? অর্ণব জানেনা এর উত্তর কি । ইসস জীবনটা যদি গল্পের মত হত । সর্বদা ‘Happy Ending’ । কিন্তু বাস্তবতা গল্পের মত সোজা রাস্তায় চলেনা , এর মোড়ে মোড়ে দুর্গন্ধময় ময়লা জমে থাকে , যা আমাদেরকে কখনো এতোটাই অসহায় বানায় যে হাতের মুঠোয় প্রাচুর্য থাকার পরেও আমরা নিঃস্ব রিক্তই থেকে যাই । হয়ত একেই নিয়তি বলে , যে নিয়তির হাতে অসহায় আমাদের অর্ণব এক বুক বেদনা নিয়ে সমাধানের আশায় প্রহর গুনে ।