Skip to main content

নীল ভালোবাসা



শহীদ মিনার জায়গাটা আমার খুব প্রিয়। বিকেলের ঝিম ধরে যাওয়া সময়টাতে সূর্য মামা যখন পশ্চিম দিগন্তে লুকিয়ে পরার প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত তখন এখানে অন্য রকম এক প্রানের মেলা বসে যায়। কতগুলো স্বপ্নপ্রান মানুষ স্বপ্ন দেখায় একটুক্ষণ ক্ষান্ত দিয়ে, কেউ বা আবার নতুন কোন স্বপ্নের প্রাসাদ বুনতে এখানে ভিড় জমায়। আমি কিন্তু উপরের কোন দলেই পড়ি না। আমি আসি মানুষ দেখতে। প্রেমিকা প্রেমিকের ঘাড়ে মাথা রেখে পরম নিশ্চিন্তে কুটকুট করে গল্প করতে থাকে, সদ্য হাঁটতে শেখা বাচ্চারা চোখে রাজ্যের বিস্ময় আর মুখে এক থালা হাসি নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে থাকে, কেউ বা সাইকেল চালাতে এসে হঠাৎ করে পরে গিয়ে লজ্জা লজ্জা মুখে এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার সাইকেলটা তুলে চালাতে শুরু করে। আমি স্বপ্নের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া মানুষ, নতুন করে স্বপ্ন দেখতে আমার ভয় হয়।] 

- ভাইয়া, একটা ফুল নেন না। (একটা ৫-৬ বছরের প্রায় উলঙ্গ ছেলে এসে আমাকে বলল)

- আমার তো ফুল দেয়ার মত কেউ নেই গো

আমার পাশে বসা হৃদিতার দিখে তাকিয়ে ওর হলুদ দাঁত গুলা বের করে বলল

-কেন আপা মনির সাথে কি আপনার ‘বেরেক আপ’ হইছে নাকি?

ওর মুখে অদ্ভুত ইংরেজি শুনে আমিও হেসে বললাম

-হ্যাঁ, ‘বেরেক আপ’ হইছে

ও তখন হৃদিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো

-আপামনি, ভাইয়ার সাথে রাগ করছেন কেন? উনি তো খুব ভালা মানুষ

-তোকে কে বলল, আস্ত একটা ফাজিল।

এবার আমার দিখে তাকিয়ে বলল

-আপনি নাকি ফাজিল

-হ্যাঁ, তোমার সাথে একটু ফাজলামি করি?

বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে ওর লজ্জা ঢাকার শেষ অবলম্বন ‘প্যান্টটা’ খুলে ফেললাম। ও কিছুটা অবিশ্বাস আর সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে আমার দিখে তাকিয়ে লজ্জাস্থান ঢাকতে ঢাকতে দৌড়ে পালালো।আমি আর হ্রিদিতা হাসতে লাগলাম।

কিছুক্ষন পর হ্রিদিতা বলল

-তুমি ওকে এখানে আসতে বলত

-মনে হয়না আমি বললে আসবে

-তবুও দেখ না আসে কি না

আমি হাতের ইশারায় ওকে আসতে বললাম। ওর সন্ধেহ এখনও যায় নি। হঠাৎ করে ওকে ধরার জন্য দৌড় দিলাম। ও কিছু বোঝার আগেই ধরে হ্রিদিতার সামনে দাড় করালাম। হ্রিদিতা বলল

-কিরে চটপটি খাবি?

-না

-কেন?

-চটপটি খাইলে আমার মাথা ঘুরে

আমি আর হ্রিদিতা আবার হেসে ফেললাম

-তাইলে কি খাবি বল?

-ফুসকা খাবো।

-ওকে.........চল।

হ্রিদিতা ছেলেটাকে নিয়ে ফুসকা খেতে গেল। আমি দূর থেকে দেখছি। কি পরম মমতায় হ্রিদিতা বাচ্চাটাকে ফুসকা খাইয়ে দিচ্ছে। তখনি আমার ছোট্ট বেলার একটা স্মৃতি মনে পরে গেলো। আমি ডিমকে ডিম বলতে পারতাম না। বলতাম ‘ইম’। আমি যখনি মা কে বলতাম মা ইম খাবো মা খিল খিল করে হেসে উঠতেন আর পরম মমতায় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। আসলে প্রত্যেক মেয়েই স্নেহের এক অনন্য আধার। তার সুযোগ পেলেই স্নেহ ঢেলে দিতে একটুও কার্পণ্য করে না।

-এই এদিকে একটু আসবে?

-কেন?

-ফুসকার টাকা দিতে হবে

-খাওয়ালেতো তুমি,আমি কেন টাকা দিব?

-প্লিজ ঝামেলা কর না তো।

আমিও আর ঝামেলা করলাম না, আজ আমার ঝামেলা না করার দিন। আমি টাকা দিলাম তারপর ছেলেটাকে বিদায় দিলাম।

-হ্রিদিতা

-বল

-তুমি কি জান আজ তোমায় অসহ্য লাগছে?

-মানে কি?

-মানে তুমি আজ এত সুন্দর করে সেজেছ যে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে। তাই বললাম।

-হি হি

- হ্রিদিতা

আর তো পারি না।

ও মনে হয় লজ্জা পেল।

-তুমি কি লজ্জা পাচ্ছ নাকি?

-পাচ্ছি ই তো। কার সামনে তার প্রশংসা করতে হয় না।

-আমি প্রশংসা করলাম কোথায়? আমি তো বলতে চেয়েছি আমার খুব বাথরুম পেয়েছে।

-সত্যি নাকি?(ও কপত রাগ দেখিয়ে বলল)

-আমি সামান্য হেসে বললাম, না।

-ফাজিল। এই প্লিজ, একটা রিক্সা দেখ না

-কেন?

-আজ সারাদিন রিক্সায় করে ঘুরব।

-হুম

আমি রিক্সা ঠিক করলাম। হ্রিদিতা রিক্সায় উঠল।

-ওকে, তুমি যাও তাহলে।

-মানে কি? তুমি যাবা না?

-তুমিই তো বললে আজ সারাদিন রিক্সায় করে ঘুরবা।

-আমি কি একা একা ঘুরবো নাকি?

-একা ঘুরবা কেন? তুমি চাইলে এই এতো মানুষের মাঝে থেকে আমি একজনকে ঠিক করে দিতে পারি। ওরা তো মনে হয় খুশি মনেই রাজি হবে।

-তুমি গেলে কি সমস্যা।

-তুমি তো জানই সুন্দরি মেয়েদের সাথে রিক্সায় উঠলে আমার শুধু ঘুম পায়।

-ওকে তুমি ঘুমিও তবু প্লিজ ভাব একটু কম মেরে রিক্সায় উঠ।

আমিও আর আপত্তি না করে উঠলাম।

রিকশাওয়ালার মনে হয় গতির নেশায় পেয়েছে। সাই সাই করে রিক্সা চলছে। হ্রিদিতার চুল এসে আমার চোখ মুখ ঢেকে দিচ্ছে। এক অন্যরকম ভাল লাগা মনকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, ও মনে হয় ভয় পাচ্ছে। চোখ মুখ শক্ত করে বসে আছে।

-এই রিকশাওয়ালাকে বলতো আস্তে চালাতে

-মামা,এই মেয়ে ভয় পেলে কিন্তু মানুষকে কামড় দেয়। তাই কামড় না খাইতে চাইলে আস্তে চালান।

কামড়ের ভয়েই বা অন্য কোন কারনেই হোক না কেন রিক্সা আস্তে চলতে শুরু করল।

হ্রিদিতা বলল

-এই আমি কি তোমার হাতটা ধরতে পারি?

-না

-কেন?

-কারন, আমি তোমার হাত ধরব। তুমি চুপ করে বসে থাকবে।

হ্রিদিতা ছোট্ট করে একটু হাসল।

আমি হ্রিদিতার হাত ধরে বসে আছি আর চারপাশের মানুষ দেখছি। সবাই কত ব্যস্ত। শুধু আমাদেরই কোন ব্যস্ততা নেই। আমরা একে অন্যের হাত খুব শক্ত করে ধরে আছি। যেন সময়টাকেও আটকে রাখতে চাচ্ছি। কিন্তু, সময় কি আর আটকে থাকে?

আমার পাশে বসে থাকা হ্রিদিতা নামের এই অতি রূপবতী মেয়েটি আর কিছুক্ষন পরই আমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবে। কাল ওর বিয়ে।

আমি হারিয়ে যাওয়া মানুষ, যাকেই জড়িয়ে ধরতে যাই সেই বাঁধন আলগা করে দূরে চলে যায়।

আজ সকালে হ্রিদিতা যখন আমার কাছে চাওয়া পাওয়ার হিসেব জানতে এল,আমি ওর মুক্তোর মত অশ্রু বিন্দুগুলো মুছে দিয়ে বলেছিলাম চল না আজ আমরা কোন পাওয়া না পাওয়ার হিসেব না করি। চল না আজ আমরা শেষ বারের মত পুরনো দিনগুলির মত হারিয়ে যাই।

কাল যখন হ্রিদিতা বাসর করবে আমি হয়ত আমার এই ছন্নছাড়া জীবনটাকে আরেকটু ছন্নছাড়া করে দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় হেটে বেড়াবো। হয়ত ভুল করে ওদের বাসার সামনেও চলে যাব। হয়ত অনেক দিনের অভ্যাসবশত আমার চোখ ওদের বাসার বারান্দার দিখে চলে যাবে। কিন্তু আগের মত আর কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে না।

Popular posts from this blog

হ্যাঁ, অনেক ভালবাসি তোমাকে

মনের মানুষের কাছে প্রথম চিঠি

তোমার দিকে তাকিয়েই থাকি